Sahabi

এক জান্নাতী সাহাবিয়ার অনন্য সাধারণ ঘটনা

আবু উসামা হাসান হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, স্বপ্নে আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ কারো নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি ফেরেশতাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তারা বললেন, ইনি হলেন রুমাইছা বিনতে মিলহান, আনাস ইবনে মালিকের আম্মা।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৪৫৬; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১১৯৫৫; তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/৪২৯; মুসনাদে তয়ালিসী, হাদীস : ১৭১৫ হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম জান্নাতে প্রবেশ করেছি। হঠাৎ দেখি আমার সামনে আবু তলহার স্ত্রী রুমাইছা।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৬৭৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫০০২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৭০৮৪; সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস : ৮১২৪ হযরত রুমাইছা বিনতে মিলহান আনসারিয়া রা.-এর উপনাম হল উম্মে সুলাইম। এ নামেই তিনি অধিক প্রসিদ্ধ। তিনি অনেক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারিনী ছিলেন। ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী সাহাবীদের মধ্যে তিনিও একজন। প্রথমে মালেক ইবনে নযরের সাথে তার বিবাহ হয়েছিল। সেই ঘরেই হযরত আনাস রা. জন্মগ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণে ক্রুদ্ধ হয়ে স্বামী মালেক ইবনে নযর দেশত্যাগ করে সিরিয়ায় চলে যায় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে তিনি হযরত আবু তালহা রা.-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। হযরত উম্মে সুলাইমের দ্বিতীয় বিবাহ (হযরত আবু তালহার সাথে) সম্পর্কে হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত আবু তালহা উম্মে সুলাইমকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। প্রতি উত্তরে উম্মে সুলাইম রা. বলেন, আপনি কি জানেন, আপনি যে উপাস্যের পূজা করেন তা জমি থেকে উৎপন্ন? (মাটি, গাছ ও খড়কুটা দিয়ে তৈরি) তিনি বললেন, হ্যাঁ। উম্মে সুলাইম রা. বলেন, গাছ-গাছালির পূজা করতে আপনার কি লজ্জা করে না? আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আপনি যদি আমার ধর্মের অনুসরণ করেন তবেই আমি আপনাকে বিবাহ করব। আপনার ইসলাম গ্রহণ করাটাই আমার মোহর। আমি এছাড়া আর কোনো মোহর চাই না। তিনি বললেন, ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখি। তারপর তিনি ফিরে এসে বললেন, আমিও আপনার ধর্মের অনুসারী। কালিমা পড়ে তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন এবং উম্মে সুলাইমকে বিবাহ করেন।-সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৩৩৪০; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ১০৪১৭ হযরত আনাস রা. যখন দশ বছর বয়সে উপনীত হলেন, তার আম্মা হযরত উম্মে সুলাইম তাকে নিয়ে রাসূলের দরবারে আগমন করলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই আমার ছেলে আনাস, আজ থেকে আপনার খেদমত করবে। তখন থেকেই আনাস রা. নিয়মিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমত করেছেন। হযরত আনাস রা. বলেন, আল্লাহ তাআলা আমার আম্মাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তিনি আমাকে উত্তমভাবে লালন-পালন করেছেন। হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে সুলাইম ও কিছু আনসারী মহিলাকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন যুদ্ধাহতদের সেবা-শুশ্রূষা ও পানি পান করাতে। হুনাইনের যুদ্ধে তিনি খঞ্জর হাতে নিয়ে রণাঙ্গনের দিকে এগিয়ে গেলেন। আবু তালহা রা. বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই যে উম্মে সুলাইম, তার হাতে খঞ্জর! উম্মে সুলাইম বললেন, কোনো মুশরিক আমার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করলে আমি এটা দিয়ে তার নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলব। হাদীস, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থগুলোতে তার বীরত্ব, সাহসিকতা, ধার্মিকতা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তবে তিনি মুসিবতের সময় ধৈর্য্যশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইতিহাসের পাতায় তার নজির খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। ইমাম বুখারী রাহ. তার বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থ সহীহ বুখারীতে তার এই ঘটনার শিরোনাম করেছেন এভাবে- ‘মুসিবতের সময় যিনি তার মর্মবেদনা প্রকাশ করেন না।’ তার সেই ঘটনার বিবরণ এরূপ- হযরত আবু তালহার সাথে উম্মে সুলাইমের বিবাহ হওয়ার পর তাদের খুব সুন্দর ফুটফুটে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম রাখা হয় উমাইর। তার ছোট একটি পাখিও ছিল, যার সাথে সে খেলত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝেমধ্যে সেই শিশুটির সাথে কৌতুক করতেন এবং বলতেন, হে উমাইর! তোমার বুলবুলির কী খবর!’ আবু তালহা রা. তাকে অত্যাধিক ভালবাসতেন। একদিন ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ল। আবু তালহা রা. এ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমনকি অস্থির হয়ে পড়লেন। তার অভ্যাস ছিল, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে আসা যাওয়া করতেন। এক বিকেলে তিনি ঘর থেকে বের হলেন। ইত্যবসরে তার অসুস্থ ছেলে মৃত্যুবরণ করল। এ দিকে উম্মে সুলাইম রা. মৃত্যুর পর ছেলেকে গোসল করালেন, কাফন পরালেন, সুগন্ধি মেখে দিলেন। কাপড়-চোপড় দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিয়ে ঘরের এক কোণে সুন্দরভাবে শুইয়ে রাখলেন। আর হযরত আনাস রা.কে পাঠিয়ে হযরত আবু তালহাকে ডেকে পাঠালেন এবং তাকে বলে দিলেন আবু তালহাকে যেন পুত্রের মৃত্যুসংবাদ না জানায়। আবু তালহা রা. সেদিন রোযা রেখেছিলেন। উম্মে সুলাইম রা. তার জন্য খানা তৈরি করলেন। আবু তালহা রা. ঘরে ফিরেই সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলেন। উম্মে সুলাইম বললেন, সে এখন আগের চেয়ে শান্ত। ক্লান্ত স্বামীকে তৎক্ষণাৎ পুত্রের মৃত্যুসংবাদ জানালেন না। ঘরের লোকদেরকেও নিষেধ করে রেখেছিলেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ যেন এ সংবাদ তাকে না জানায়। হযরত আবু তালহা রা. তার কথা শুনে ভেবেছিলেন ছেলে তাঁর সুস্থ হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তাই তিনিও নিশ্চিন্ত মনে রাতের খাবার খেলেন এবং বিশ্রাম নিলেন। এমনকি ভোরে গোসলও করলেন। হযরত আবু তালহা রা. বের হওয়ার আগে উম্মে সুলাইম রা. তাকে বললেন, বলুন কেউ যদি কারো কাছে কোনো কিছু গচ্ছিত রাখে অতপর তার কাছে তা ফেরত চায় তবে তার কি অধিকার আছে তা ফেরত না দিয়ে নিজের কাছে আটকে রাখার? আবু তালহা রা. বললেন, না তার এ অধিকার নেই। হযরত উম্মে সুলাইম এবার শান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনার পুত্রের ব্যাপারে সবর করুন। আল্লাহ তাআলা তাকে আমাদের কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন তারপর তিনি ফিরিয়ে নিয়েছেন। আবু তালহা রা. এতে রাগান্বিত হলেন এবং রাতের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট স্ত্রীর নামে অভিযোগ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ঘটনা শুনে বিমুগ্ধ হলেন এবং দুআ করলেন-‘আল্লাহ তোমাদের এ রাতে বরকত দান করুন।’ তারপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আবদুল্লাহ নামে আরেকটি পুত্র সন্তান দান করলেন। সেই আবদুল্লাহ ইবনে আবু তালহাকে পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা সাত পুত্র দান করলেন, যাদের প্রত্যেকেই কুরআনের আলেম হয়েছেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৩০১; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১২০৮; ফাতহুল বারী ৩/২০১; তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/৪৩১-৩২ আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এই হাদীসের অনেক ফাওয়ায়েদ উল্লেখ করেছেন। প্রথমে তিনি উম্মে সুলাইমের বৈশিষ্ট্য ও মহত্ব বর্ণনা করেছেন যে, তিনি উক্ত ঘটনার মাধ্যমে তার প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, সহিষ্ণুতা ও নেক গুণাবলির পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমে স্বামীকে পুত্রের মৃত্যু সংবাদ না জানিয়ে তাকে নিশ্চিন্তে রাত্রিযাপনের সুযোগ দিয়েছেন। সন্তানের মৃত্যুকে গচ্ছিত বস্ত্তর ফেরৎ নেয়ার সাথে উদাহরণ দিয়ে শোকার্ত স্বামীকে যেমন সান্ত্বনা দিয়েছেন তেমনি আল্লাহর ফয়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা যখন তার উদ্দেশ্য ও নিয়তের সততা সম্পর্কে জানলেন তার মর্যাদা বৃদ্ধি করলেন এবং তিনি আল্লাহর রাসূলের বরকতের দুআ লাভ করলেন। এক্ষেত্রে শিক্ষণীয় বিষয় হল আল্লাহ তাআলার ফয়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া। বিপদ-আপদে ধৈর্য্য ধারণ করা এবং আল্লাহর কাছে উত্তম বিনিময় প্রত্যাশা করা। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থবোধক বাক্য ব্যবহার করা। স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য সাজসজ্জা গ্রহণ করা ইত্যাদি।
[]